বেশ কিছু দিন যাবত ধূমপানের নতুন ফরমেট ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকায় এটা নিয়ে নানা ব্যাখা বিশ্লেষণ, আলোচনা-পর্যালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। আমাদের দেশেও এসব নিয়ে আলোচনা চলছে।
ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং আসলে কি
ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট বা পারসোনাল ভ্যাপোরাইজার হচ্ছে প্রচলিত সিগারেটের একটি আধুনিক বিকল্প। এগুলো সাধারণত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি দ্বারা চালিত হয় এবং এক ধরণের জলীয় বাষ্প তৈরী করে। এ প্রযুক্তিতে ব্যাটারি অন করার পর এটি একটি হিটিং কয়েলকে উত্তপ্ত করে যাকে এটোমাইজার বলা হয়। কম তাপমাত্রায় এটি একটি বিশেষ ধরণের তরল পদার্থকে বাষ্পীভূত করে যেটিকে সিগারেটের ধোঁয়ার মত মনে হয়। প্রচলিত সিগারেটের মতই এ বাষ্প ধুমপায়ীদের দেয় সিগারেটের তৃপ্তি।
কেন এত আলোচনা?
নতুন এই ডিভাইস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। চলছে গবেষণাও। কানাডা-নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ বৈধ করেছে। ভারত এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। নির্দিষ্ট আইন-কানুনের আওতায় উন্নত এসব দেশ অ্যালাউ করছে। ব্রিটেনে এমপিদের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে মানুষের শরীরে ৭০০০ ক্ষতিকর রাসয়নিক ঢোকে। কিন্তু ভ্যাপিংয়ে শুধু নিকোটিন থাকে। চাইলে নিকোটিনের মাত্রা কমিয়ে নিতে পারবেন। তাতে ধীরে ধীরে ধূমপানের দীর্ঘ দিনের আসক্তি কমবে। এছাড়াও ভ্যাপিং বা ই-সিগারেট সাধারণ বা তামাকের সিগারেটের থেকে ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকর। ফলে ই-সিগারেটের ব্যবহার সহজলভ্য হলে, সেটা অনেক মানুষকে তামাকের সিগারেটের ব্যবহার বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভেপিং সংক্রান্ত অসুস্থতা বৈশ্বিক ই-সিগারেট খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন (এফডিএ) পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে দেখেছে, দেশটিতে এই পরিস্থিতির জন্য ই-সিগারেট দায়ী নয়, বরং ভেপিং যন্ত্রের ভেতর অন্য নেশাজাতীয় ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহারের কারণেই অসুস্থতার ঘটনা ঘটেছে। যেমন: ভ্যাপিং যন্ত্রের ভেতর একসাথে ভ্যাপিং আর গাজা খাওয়ার কুফল। সাথে আছে কমদামি চায়না ডিভাইস। যার ফলে এমন দূর্ঘটনা ঘটছে।
নিষিদ্ধ করলে কি হবে?
বাংলাদেশে এটা কি বৈধ? উত্তর যদি না হয় তাহলে অভিজাত এলাকার তরুণ ও কর্পোরেট কর্তাদের হাতে যে ডিভাইস সেটা কিভাবে পাওয়া যায়? সরকার এখান থেকে কি কোন রেভিনিউ পায়? যদি না পায় তাহলে অবৈধ পথে আসে। কালোবাজারের আর একটা পথ। কিংবা নিষিদ্ধ করলে ধূমপান আইনের মতো হবে হয়তো। প্রকাশে ধূমপান করলে যেমন জরিমানা। আর বাস্তব!
অর্থাৎ নিষিদ্ধ করলেও এখনকার মতো রাস্তায় পাওয়া যাবে আর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সর্বত্র সবার হাতে থাকবে। ই-সিগারেট খাত নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেপিং নিষিদ্ধ করা হলে তা ভালোর বদলে বরং উল্টো ফল দেবে। এতে একদিকে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারে ঝোঁক বাড়াবে। পাশাপাশি অধিকসংখ্যক ভোক্তা অনিরাপদ ও নিম্নমানের ভেপিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এতে জনস্বাস্থ্য আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সমাধান কি?
ইসকুল, কলেজে ওঠার আগেই পাঙ্খা গজানো পোলাপান বিড়ি-গাজায় টান দেয়। কৈশর পেরতে না পেরতেই তারা চেইন স্মোকার। তাতে বছরে বছরে নতুন নতুন ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেটা কমানোর জন্যই প্রতিবছরই বাজেটে সিগারেটে দাম বাড়ানো হয়। এই মূল্য বৃদ্ধির সুফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে’র রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ৮ বছর ২১.৭ শতাংশ ধূমপায়ী হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে গেল বছর ১২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল সংসদে বলেছেন, ‘তামাক পণ্যের উপর পৃথক পৃথকভাবে উচ্চমূল্য ও উচ্চ সম্পূরক শুল্ক হার নির্ধারন করা হয়েছে যা এই উপমহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।’সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা অবৈধ সিগারেট উৎপাদন ও বিস্তারকারী চক্রের কারনে। ২০১৮ সালের মে মাসের অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি চিঠিতে বলা হয়েছিলো অবৈধ সিগারেটের বাজার ৮০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকার। আর এবছর মে মাসের এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অবৈধ সিগারেটের বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অবৈধ সিগারেটের বাজার বেড়ে গেছে প্রায় ২৫০ শতাংশ। একই রকম ভাবে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে অবৈধ সিগারেট বাজারের মতো একসময় ছড়িয়ে পড়বে ভ্যাপিংয়ের অবৈধ বাজার। সেলক্ষ্যে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত রেগুলেশন দরকার।
লাভ কি?
ই-সিগারেট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণেই অনেকে হুট করে তা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই উদ্যোগে বরং নেতিবাচক ফল আনতে পারে। ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে ই-সিগারেট। তা নিষিদ্ধ করা হলে ধূমপান ছাড়ার উদ্যোগে বাধাগ্রস্ত হতে পারে । তাই বাস্তব ও মানসম্মন্ন রেগুলেশনের আওতায় আনলে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে মাননীয় প্রধাণমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশের ভিশন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।