ধূমপানের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন ই-সিগারেট (ভেপ)। বলা হয়ে থাকে, ধূমপানে আসক্তি কমাতে ও এর দৌরাত্ম্য ঠেকাতে তামাকবিহীন ই-সিগারেট তুলনামূলক ভালো সমাধান হতে পারে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) এক গবেষণায় দাবি করে, ধোঁয়ার চেয়ে বাষ্প অনেক বেশি নিরাপদ। তামাকের সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেট (ভেপ) স্বাস্থ্যের জন্য অনেক কম ক্ষতিকর। তামাক সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ কম বলে দাবি করা হয় সেই গবেষণায়। ই-সিগারেট প্রস্ততকারীদের দাবি, এতে শুধু নিকোটিন স্বল্প পরিমানে থাকে যা শুধু ধূমপায়ীদের মধ্যে সিগারেটের অনুভূতি তৈরি করতে সাহায্য করে। কিন্তু শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি করে না। বাংলাদেশে সিগারেট ছাড়তে অনেককে গত কয়েক বছর ধরে ভেপ ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এছাড়াও ই-সিগারেট বা ইলেক্ট্রনিক সিগারেট সম্প্রতি সারাবিশ্বে আলোচিত হয়ে উঠেছে। অবৈধ মারিজুয়ানা ভেপিং পণ্যের (টিএইচসি অয়েল) ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফুসফুস সংক্রান্ত বেশ কিছু অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার কয়েকটি প্রদেশে ভেপিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ও সেন্টার্স ফর ডিসিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন ই-সিগারেটের পক্ষে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ রিপোর্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রদেশে ভেপিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল তা ইতিমধ্যে স্থগিত করা শুরু হয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে। প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকর বলে দাবি করছে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড এর তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান মার্টিন ডকরেল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি ফুসফুস সংক্রান্ত অসুস্থতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ই-সিগারেট যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে জানা গেছে, ই-সিগারেট বা ভেপিং নয়; অনিরাপদ, মানহীন প্রিফিল্ড কার্টিজ ব্যবহারই এর যথাযথ কারণ। এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন লিন্ডা বোল্ড, এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি ইংল্যান্ড। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সে দেশের ভেপ ব্যবহারকারীদের জানিয়েছেন, অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ যুক্তরাজ্যে ই-সিগারেটের জন্য ব্যবহৃত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে সঠিক নজরদারি থাকায় সে দেশে ভ্যাপিং সম্পর্কিত কোনো অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এদিকে ব্রিটেনে যারা ধূমপান ছাড়তে চান তাদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভেপিং। কারণ এর মাধ্যমে সাধারণ ধূমপানের তুলনায় কম ক্ষতি করে এমন মাত্রায় নিকোটিন গ্রহণের সুযোগ পান তারা। যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাপিং নিয়ে চলমান শঙ্কা ও বিতর্কের মধ্যে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ই-সিগারেট সম্পর্কে আমাদের পরামর্শ অপরিবর্তিত রয়েছে। ভ্যাপিং ঝুঁকিহীন না; কিন্তু ধূমপানের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর। ভেপিংয়ে ধূমপানের তুলনায় ক্ষতির আশঙ্কা সামান্য এবং ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক; কারণ এতে শুধু ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয় না।’ যুক্তরাজ্যে একটি আস্থাশীল সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে ভ্যাপিং পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করায় সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এ সম্পর্কিত অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তাই ভ্যাপিংয়ের কারণে যেখানে ৮শ’র মতো ফুসফুস-সংক্রান্ত অসুস্থতা এবং ১৩টি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ সেখানে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সে দেশের ভেপ ব্যবহারকারীদের জানিয়েছে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। অনুসন্ধানের প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, মূলত অবৈধ, অনিরাপদ ই-লিকুয়িড ব্যবহারের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাস্তার ধারে টং দোকানের আদলে গড়ে ওঠা এসব স্থান থেকে প্রাপ্ত ই-লিকুয়িড বা নিজ উদ্যেগে বানানো ই-লিকুয়িড ব্যবহার অপচেষ্টায় এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এসব পণ্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় টিএইচসির মতো কেনাবিস পণ্য বা স্পাইসের মতো সিনথেটিক কেনাবাইনয়েডস। যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লিন্ডা বল্ড বলেন, ‘এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য প্রমাণ এটা স্পষ্ট যে অবৈধ মারিজুয়ানা ভেপিং পণ্যের (টিএইচসি অয়েল) কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। নির্দিষ্ট করে বললে টোকোফেরল একিলেট মিশ্রণটিই হয়তো এজন্য দায়ী।’ অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ এবং সিডিসি সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর অনুসন্ধান ও গবেষণা করে যে তথ্য দিয়েছে, তার সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পুরোপুরি মিলে যায়। সবশেষ, গত ৫ অক্টোবর এফডিএ এর কমিশনার ডা. নেড শার্পলেস এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, টিএইচসি কার্টিজ দিয়ে ভেপিং করার কারণেই কিছু মানুষ অসুস্থ হয়েছে। তাই ভেপিংয়ে ক্ষেত্রে টিএইচসি কার্টিজ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন তিনি। টিএইচসি কার্টিজ দিয়ে ভেপিং করতে নিষেধ করে বার্তা দিয়েছে এফডিএ এর অফিসিয়াল সাইট। সেখানে ফুটপাত থেকে মানহীন ভেপিং প্রোডাক্ট বা লিকুইড কিনতেও নিষেধ করা হয়েছে। যারা মানসম্পন্ন ই-লিকুইড দিয়ে ভেপিং করছে, তাদের ভেপিং চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। প্রচলিত তামাজাত সিগারেটে ফেরত যেতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে ভেপি বা ই-সিগারেটের সঙ্গে প্রচলিত তামাকজাত সিগারেটের পার্থক্য কি? প্রচলিত একটি তামাকজাত সিগারেট পুরনোর সময় প্রায় সাত হাজারের মতো কেমিকেল ধূমপায়ীর শরীরে প্রবেশ করে এবং তামাক পুরনো ছাই থেকে সৃষ্ট এসব কেমিকেলই মূলত ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। অপরদিকে ভেপিংয়ের লিকুইডের মূল উপাদান পিজি এবং ভিজি। এই দুটি উপাদানের সঙ্গে নিকোটিন মিশ্রিত করে তৈরি করা হয় ভেপিংয়ের লিকুইড এবং লিকুইড তৈরির মূল উপাদান হিসেবে এফডিএ অনুমোদিত ফুডগ্রেডেড পিজি ও ভিজি ব্যবহার করা হয় এবং ভেপিংয়ের সময় আমরা যে ধোঁয়া সৃষ্টি হতে দেখি সেটি আসলে ধোঁয়া নয়, এটি হচ্ছে একপ্রকার বাষ্প যাকে ক্লাউড বলা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত ভেপ ব্যবসায়ীদের কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশেও এখন অনেকে ভেপ ব্যবহার করছে। যাদের প্রতিদিন দুই-তিন প্যাকেট সিগারেট লাগতো, তাদের জন্য সিগারেটের নিরাপদ বিকল্প হিসাবে দাঁড়িয়েছে ই-সিগারেট (ভেপ)। কারণ ভ্যাপিং ঝুঁকিহীন না কিন্তু ধূমপানের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিকর। তবে মিডিয়াতে সম্প্রতি যে সংবাদ প্রচার হচ্ছে সেটি আমাদের দেশের নয়, মানহীন পণ্যেও কিংবা অনিরাপদ ই-লিকুয়িড ব্যবহারের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা দাবি করেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো অনিরাপদ ই-লিকুয়িড বা টিএইচসি অয়েল পাওয়ার সম্ভবনা নেই। কাজের নিরাপদেই দেশের ভেপাররা ভেপিং করতে পারছেন।